কাউসার চৌধুরী :
প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেট এম এ জি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর যেন স্বর্ণ চোরাচালানের নিরাপদ রুটে পরিণত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ দুবাই থেকে আসছে একের পর এক স্বর্ণের চালান। ১০ বছরে এই বিমানবন্দর থেকেই জব্দ করা হয়েছে ১৫৩ কেজি স্বর্ণ। মণ হিসেবে এর ওজন প্রায় ৪ মণ। জব্দকৃত স্বর্ণের বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ১৬০ কোটি টাকা। সর্বশেষ গত বুধবার সকালে ১৭ কোটি টাকা মূল্যের ১৬ কেজি ওজনের স্বর্ণের চালান জব্দ করা হয়।
অভিযোগ রয়েছে, ওসমানী বিমানবন্দরে একের পর এক স্বর্ণের চালান আটক হলেও এর মূল মালিক বা নেপথ্যের কারিগরদের শনাক্ত করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মূল হোতারা সবসময়ই রয়ে গেছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। বুধবারের আটক হওয়া স্বর্ণ চোরাচালানের হোতা দেশের এক শীর্ষ এক স্বর্ণ চোরাকারবারী বলে জনশ্রুতি রয়েছে। যিনি ডায়মন্ড ব্যবসার সাথেও সম্পৃক্ত।
এয়ারপোর্ট থানার ওসি সৈয়দ আনিছুর রহমান গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সিলেটের ডাককে বলেন, স্বর্ণ চোরাচালানের ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃত আসামিকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এই স্বর্ণ চোরাচালানের মূল হোতা শনাক্ত করতে সবধরনের তদন্ত কার্যক্রম চালানো হবে।
অনুসন্ধান বলছে, ওসমানী বিমানবন্দরকে ঘিরে একটি শক্তিশালী চোরাচালানি চক্র সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে স্বর্ণের চালান নিয়ে আসছে। এর বাইরে সৌদি আরব থেকেও মাঝে মধ্যে স্বর্ণের ছোট ছোট চালান আসে। তবে, আটক হওয়া চোরাচালানের মধ্যে বেশিরভাগ চালানই দুবাই থেকে নিয়ে আসা হয়। যাত্রীবেশে স্বর্ণের চোরাচালান নিয়ে আসলেও মূলত দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছানোর লক্ষ্যে নিয়ে আসা হয়। আর এক্ষেত্রে স্বর্ণ চোরাচালানিদের নিরাপদ রুট হয়ে উঠেছে প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেট এম এ জি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ওসমানী বিমানবন্দরে গত বুধবার থেকে বিগত ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে ১৫৩ কেজি স্বর্ণ জব্দ করা হয়। সর্বশেষ গত বুধবার সকালে সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজাহ থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট (বিজি-২৫২) ওসমানী বিমানবন্দরে অবতরণ করে। ওই ফ্লাইটের যাত্রী ছিলেন হোসাইন আহমদ। তার কাছে থাকা লাগেজে তল্লাশি চালিয়ে একটি জুস মেশিনে ১০৫টি স্বর্ণের বারসহ আরও কিছু স্বর্ণ পাওয়া যায়। জব্দকৃত সোনার ওজন ১৫ কেজি ৯১৫ গ্রাম। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ১৭ কোটি টাকা। পরে হোসাইন আহমদকে গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতারকৃত হোসাইন আহমদ সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার তোয়াকুল বাজার এলাকার গোরামারাকান্দি গ্রামের নুরুল ইসলামের পুত্র। ওই যাত্রী শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের চোখ ফাঁকি দিয়ে বিমানবন্দরের গ্রিন চ্যানেল পার হয়ে পার্কিংস্থলে চলে যান। পরে ওসমানী বিমানবন্দরে কর্মরত এভিয়েশন কর্মকর্তা ও গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) কর্তব্যরত সদস্যরা তাকে চ্যালেঞ্জ করে পুনরায় গ্রিন চ্যানেলে নিয়ে আসেন এবং তার কাছ থেকে স্বর্ণ উদ্ধার করেন। এ ঘটনায় ওসমানী বিমানবন্দরের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা আকরামুল আজিম বাদী হয়ে বুধবার রাতেই এয়ারপোর্ট থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দায়ের করেন। মামলা নং-১৫।
এর আগে গত বছরের ৮ ডিসেম্বর শুক্রবার সকালে বাংলাদেশ বিমানের বিজি-২৪৮ নম্বর ফ্লাইটের চার যাত্রী ও বিমানের টয়লেট থেকে ৩২ কেজি ৬৫ গ্রাম ওজনের ২৮০টি বার ও দেড় কেজি ওজনের ৬টি লিক্যুইড গোল্ড জব্দ করে কাস্টমস। এ ঘটনায় সম্পৃক্ত বিমানের চার যাত্রী হাবিবুর রহমান (৩৮), মো. সানু মিয়া (৩৫), মো. আক্তারুজ্জামান (৪০) ও মিসফা মিয়াকে (৪৯) গ্রেফতার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে এয়ারপোর্ট থানায় চোরাচালান আইনে মামলা দায়ের করা হয়। ওই মামলার তদন্ত কার্যক্রম এখনো চলছে।
এরও আগে ২০২২ সালের জুন মাসে মাত্র পাঁচ দিনের ব্যবধানে দুটি চোরাচালান ধরা পড়ে। ২ জুন দুবাই ফেরত যাত্রী ময়নুল ইসলাম শাকিলের কাছ থেকে ১ কেজি ১৬০ গ্রাম স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়। এর আগে ২৭ মে আলী আহমদ নামের আরেক যাত্রীর কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় সমপরিমাণ স্বর্ণ।
২০২১ সালের ২৭ ডিসেম্বর ৭ কোটি টাকা মূল্যের ১১ কেজি ২২০ গ্রাম স্বর্ণসহ দুবাই থেকে আসা চার যাত্রীকে আটক করে কাস্টমস। এই চার যাত্রী ব্লান্ডার মেশিন ও আয়রন মেশিনের ভেতরে কৌশলে এই স্বর্ণ নিয়ে আসেন।
ওই বছরের ৮ নভেম্বর দুবাই ফেরত যাত্রী নরেন্দ্র নাথের কাছ থেকে ৬ কেজি ১৪৮ গ্রাম ওজনের ৩৮ পিস স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত স্বর্ণের দাম প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। পরে নরেন্দ্র নাথকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়।
২০২০ সালের ১৮ ডিসেম্বর দুবাই থেকে আসা জামিল আহমদ (২৮) নামের এক যাত্রীর কাছ থেকে ১৪টি স্বর্ণের বার ও কিছু স্বর্ণালংকার উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত স্বর্ণের ওজন প্রায় দুই কেজি। যার দাম প্রায় ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। ১২টি বার বিশেষ ব্যবস্থায় জামিলের উরুতে আটকানো ছিল।
২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবী থেকে আসা জাহিদ হোসেন নামের এক যাত্রীর কাছ থেকে ৪ কেজি ৬৪ গ্রাম ওজনের ৪০টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার হওয়া স্বর্ণের দাম প্রায় ২ কোটি টাকা।
একই বছরের ৩ জানুয়ারি ফ্লাই দুবাই দিয়ে আসা একটি ফ্লাইটে তল্লাশি চালিয়ে ৬০ পিস স্বর্ণের বার উদ্ধার করে কাস্টমস। উদ্ধারকৃত স্বর্ণের ওজন প্রায় ৭ কেজি। যার দাম প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এ ঘটনায় বাংলাদেশ বিমানের মেকানিক্যাল অ্যাসিসট্যান্ট কারিমুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়। ২০১৭ সালের ২৩ জুলাই আবুধাবি থেকে আসা বিমানের লাগেজ হোল্ডে অভিযান চালিয়ে ৩ কেজি ৫০০ গ্রাম ওজনের ৩০টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়। বিমানের ওই ফ্লাইটটি সিলেট হয়ে ঢাকায় ফিরছিল। স্বর্ণের এই চালান আটক করা হলেও এর সাথে জড়িত কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি।
২০১৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর দুবাই থেকে আসা বিমানে তল্লাশি চালিয়ে ১৬টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত স্বর্ণের ওজন ১ কেজি ৮৭২ গ্রাম। এ ঘটনায় কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি। একই বছরের ১৬ নভেম্বর ওসমানী বিমানবন্দর থেকে ৯ কেজি ৩০০ গ্রাম ওজনের ৮০টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করে কাস্টমস। উদ্ধারকৃত স্বর্ণের দাম প্রায় ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি বিমানের আসনের নিচে তল্লাশি চালিয়ে এসব স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়। দুবাই থেকে আসা ওই বিমানের দুটি সিটের নিচ থেকে কাগজে মোড়ানো অবস্থায় স্বর্ণের বারগুলো উদ্ধার করা হয়। তবে, এ ঘটনায় কাউকে আটক করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
ওই বছরের ১৭ মার্চ ৫৮০ গ্রাম ওজনের ৫টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায়ও কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি। ২৪ এপ্রিল এক লন্ডন প্রবাসীর কাছ থেকে ৪৩২ গ্রাম স্বর্ণ উদ্ধার করে কাস্টমস। পরে ব্যাগেজ রুলস মোতাবেক বিষয়টি নিষ্পত্তি করা হয়।
২০১৫ ও ২০১৪ সালে ওসমানী বিমানবন্দর থেকে ১৯ কেজি স্বর্ণ উদ্ধার করে কাস্টমস। এছাড়াও ১০০ ও ২০০ গ্রাম স্বর্ণ আটক, শুল্কায়ন, ন্যায় নির্ণয়নের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে বলে সূত্র জানিয়েছে।